মেঘনার লক্ষ্মীপুর সীমান্তে চিংড়ি রেণু ঘিরে কোটি টাকার চাঁদাবাজি
লক্ষ্মীপুরের চার উপজেলা রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর ও রায়পুরের মেঘনা নদী ও তৎসংলগ্ন সংযোগ খাল থেকে প্রতিমাসে অপরিকল্পিতভাবে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণু শিকার করছে ৬০-৭০ হাজার স্থানীয় এলাকাবাসী ও জেলে। রায়পুর থেকে রামগতির টাংকি বাজার পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কি.মি. এলাকায় বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত চলে এ শিকার উৎসব।
অভিযোগ উঠেছে, চিংড়ি রেণু আহরণ ‘অবৈধ’ এ শব্দটির ভয় দেখিয়ে শিকার মৌসুমে শিকারী ও ব্যবসায়ীদের নিকট হতে বিভিন্ন ঘাট ও সড়ক পথের মোড়ে মোড়ে মাসে প্রায় কয়েক কোটি টাকার চাঁদা হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক পরিচয়ের কিছু কর্মী ও প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন কর্তা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের চার উপজেলার মধ্যে রামগতি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২শ ড্রামে কমপক্ষে ৩০ লাখ, কমলনগরে দেড় শতাধিক ড্রামে কমপক্ষে ১৮ লাখ, সদর উপজেলায় প্রায় ৩০ ড্রামে কমপক্ষে ৫ লাখ, রায়পুর থেকে শতাধিক ড্রামে কমপক্ষে ১৫ লাখ রেণু বিভিন্ন অঞ্চলে চালান করা হয়। প্রতিটি ৩.৫ টাকা হারে যার বর্তমান বাজার মূল্য দৈনিক প্রায় আড়াই থেকে ৪ কোটি টাকা এবং মাসে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা।
কিন্তু মৎস্য বিভাগের মতে কান্ডজ্ঞানহীন উপায়ে চিংড়ি রেণু শিকার করতে গিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে ভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার কোটি সাদা মাছের পোনা এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। ফলে অদূর ভবিষ্যতে মেঘনা নদী মাছ শূন্য হয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ ব্যক্তিরা।
চিংড়ি রেণুর ব্যবসায় বর্তমানে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ জানার পর সরেজমিনে মেঘনাপাড়ের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ঘুরে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান মেঘনা নদী থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ গলদা ও বাগদা চিংড়ি রেণু খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে চালান করতে গিয়ে নৌ ও সড়ক রুট ম্যানেজের নামে নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা গুনতে হচ্ছে তাদের। তাদের অভিযোগ সব চাঁদাই মূলত স্বঃ স্বঃ ঘাটের স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা বিভিন্ন সংস্থার নামে আদায় করছে। চাঁদা দিতে হয় দৈনিক এবং মাসিক দু’ভাবে। স্থানীয় পুলিশ কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ট্রলারের ভাড়ার সাথে ড্রাম প্রতি ২শ থেকে ৪শ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে প্রতি পদে পদে চাঁদা না দিলে তাদের চিংড়ি আটকে দেয়া হয়।
রেণু শিকারী ও ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে- প্রতিদিন রামগতির আদালত ঘাট, রামগতি ঘাট, গাবতলী ঘাট, সেন্ট্রার খাল, টাংকিবাজার ঘাট, কমলনগরের মতিরহাট ঘাট, তালতলী, বাত্তির ঘাট, কটরিয়া, সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাট, বুড়িরঘা এবং রায়পুরের হাজীমারা, নতুন ব্রীজ, পানির ঘাট, বালুর চর, মেঘনার বাজার, পুরান বেড়ী, বেড়িঁর মাথা, হাজিমারা, মেঘনা ঘাট দিয়ে ট্রলারযোগে ওই চিংড়ি রেণুর ড্রামগুলো যাচ্ছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে। আবার সড়ক পথে ছোট ট্রাকে যাচ্ছে দেশের পূর্বাঞ্চলে। জেলার ৪টি উপজেলার প্রায় ২শ’ জন স্থানীয় ব্যবসায়ী চিংড়ি রেণুর এ ব্যবসার সাথে জড়িত। দৈনিক চাঁদার বাহিরেও এ সকল ব্যবসায়ী জনপ্রতি মাসিক ৩ হাজার টাকা হারে চাঁদা দিচ্ছে।
সূত্রমতে, জেলার ছোট বড় ২০টি ঘাট থেকে মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যার মধ্যে রামগতির ৫টি ঘাটে দেড়শ’ থেকে ২শ’ ড্রামে প্রায় ৪০ হাজার, কমলনগরের ৩টি ঘাটে ১শ’ থেকে দেড়শ’ ড্রামে ৩৫ হাজার, সদরের ২টি ঘাটে প্রায় ১০ হাজার এবং রায়পুরের ৪টি ঘাট থেকে ১শ’ থেকে দেড়শ’ ড্রামে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার টাকার চাঁদা দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
এ টাকা আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগের নামধারী নেতারা। তবে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করলেও ভয়ে কোনো নেতার নাম উল্লেখ করেনি। এ সম্পর্কে কমলনগর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ফজলুল হক সবুজের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো নেতা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে যদি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় আমি মনে করি, তারা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যই এমনটি করছে। তারা দলের শত্রু।
এদিকে রেণু আহরণকারী নদী ভাঙ্গনের শিকার বুড়ির ঘাটের মালেকা বেগম (৩৫) স্থানীয় ভাষায় জানান, সিজনের জন্য আমরা ৩শত শিকারী মেঘনাপাড়ের ২শ হাত ভাঙ্গা জমি ভাড়া নিয়েছি প্রতি হাত ৫শ টাকা হারে। স্থানীয় এক নেতা ওই টাকা নিয়েছে। কিন্তু ওই জমির মালিক সে নয়। এভাবে রেণু শিকারীদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে নদীরপাড় বা মাছ ধরার জন্য চরের সীমানার বন্টন দিয়ে। চিংড়ি আহরণকারীরা নদী পাড়ের নির্দিষ্ট এলাকা পোনা ধরার জন্য ভাড়া নেয় । সম্পূর্ণ মালিক বিহীন এ নদীপাড়কে ভাড়া দেয় স্থানীয় মাস্তান বা রাজনৈতিক নেতাকর্মী অথবা এলাকার নেতৃত্বে থাকা নেতারা।
পোনা ব্যবসায়ী শরীয়তপুরের শহিদুলের ভাষ্যমতে চাঁদা দেয়ার পেছনের মূল কারণ চিংড়ি রেণু ধরা ও পরিবহন নিষিদ্ধ। তাই ঘাটে ঘাটে চাঁদার মাধ্যমেই মূলত তারা এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মেঘনাপাড় ঘুরে চিংড়ি আহরণকারী জেলে, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত তিন মাস মেঘনায় চিংড়ি রেণু আহরণে মেতে ওঠে শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সের প্রায় ৬০-৭০ হাজার স্থানীয় জেলে।
এ সময় মেঘনা পাড়ের জেলেরা মশারী, নেট জাল, ছাকনী ও চাদর দিয়ে এ প্রাকৃতিক পোনা শিকার করে। শিকারের সময় এক একটি চিংড়ি পোনার সাথে কয়েক শত নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ শিকারীদের জালে ধরা পড়ে। কিন্তু শিকারীরা তাদের কাংখিত চিংড়ি পোণা রেখে বাকি সামুদ্রিক জীবগুলোকে নদীতে না ফেলে ডাঙ্গায় ফেলে দেয়। তাতে মূল্যবান ইলিশ রেণুসহ শতশত প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের পোনা নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে মেঘনা পাড়ের পরিবেশ। ফলে দিন দিন মেঘনা নদীতে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাদা মাছের আকাল দেখা দিচ্ছে।
চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ে ব্যাপক চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ জুনাইদ কাউছার বলেন, পুলিশ বা অন্য কারো নামে চাঁদাবাজির খবর আমাদের জানা নেই। কারো বিরুদ্ধে এ রকম সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল চন্দ্র ঘোষ জানান, সরকার প্রাকৃতিক উৎস থেকে রেণু পোনা ধরা নিষিদ্ধ করেছে। তবে লক্ষ্মীপুর অঞ্চল ইলিশ অভয়াস্থলের পাশাপাশি গলদা ও বাগদা চিংড়ি রেণু উৎপাদনেরও উৎসস্থল হয়ে উঠেছে। মৎস্য বিভাগ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে জেল জরিমানা করা হচ্ছে। আমাদের জনবল এবং যন্ত্রপাতি খুবই সীমিত। তাই শিকারী এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া শিকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি কোনো এনজিও’র মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
জেলেদের নিয়ে কাজ করে এ রকম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক) এর কমলনগর উপজেলা সমন্বয়কারী মোঃ মোকাম্মেল হোসেন জানান, জাটকা ও ডিমওয়ালা ইলিশ বিষয়ে ‘কোডেক’র একটি প্রকল্প ২০১৩ সাল থেকে বন্ধ আছে । কিন্তু চিংড়ি রেণু নিয়ে কোনো এনজিও’র সচেতনতামূলক কার্যক্রম তার জানা নেই।
জানা যায়, ২০০০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে দেশের উপকূলীয় এলাকায় মাছের পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু নিষিদ্ধ হলেও থেমে নেই পোনা শিকার, আর এ সুযোগেই মূলত চাঁদাবাজি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তাই অন্য মাছের প্রজাতি বিনষ্ট না করে নদী থেকে এ রেণু ধরার অনুমতি দিতে দাবি জানান চাষীরা।
-সানা উল্লাহ সানু